আইনস্টাইন একটি গোপন চিঠি লিখেছিলেন সে সময়ের আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের কাছে। কি ছিল সেই চিঠিতে? ঐ বিখ্যাত চিঠিটি লেখা হয়েছিলো ২ আগস্ট ১৯৩৯ সালে, চিঠিটির ড্রাফট করেন অন্য একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী লিওজিলার্ড এবং চিঠিতে স্বাক্ষর করেছিলেন বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন।
এখানে বিজ্ঞানী লিওজিলার্ড সম্পর্কে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। লিওজিলার্ড এর জন্ম ১৮৯৮ সালে হাঙ্গেরিতে। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ১৬ বছরের লিওজিলার্ডকে বাধ্যতামূলকভাবে সৈন্য বাহিনীতে ভর্তি করা হয়। যুদ্ধের বীভৎসতা এবং সামরিক বাহিনীর অকথ্য অত্যাচার তার জীবনকে এমনভাবে আঘাত করেছিলো যে তার মধ্যে জেগে উঠেছিলো এক প্রচন্ড যুদ্ধবিরোধী মনোভাব। তিনি ছিলেন জার্মানীর বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় গুটেনজেনের ছাত্র এবং তিনি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন আইনস্টাইন, প্লাঙ্ক, মেস্ট, ভসলের মতো নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানীদের। আইনস্টাইনের চিঠি পাওয়ার ফলে আমেরিকাতে পরমাণু বোমা তৈরির জন্য বিজ্ঞানীরা একযোগে কাজ শুরু করেন।
এখানে বিজ্ঞানী লিওজিলার্ড সম্পর্কে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। লিওজিলার্ড এর জন্ম ১৮৯৮ সালে হাঙ্গেরিতে। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ১৬ বছরের লিওজিলার্ডকে বাধ্যতামূলকভাবে সৈন্য বাহিনীতে ভর্তি করা হয়। যুদ্ধের বীভৎসতা এবং সামরিক বাহিনীর অকথ্য অত্যাচার তার জীবনকে এমনভাবে আঘাত করেছিলো যে তার মধ্যে জেগে উঠেছিলো এক প্রচন্ড যুদ্ধবিরোধী মনোভাব। তিনি ছিলেন জার্মানীর বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় গুটেনজেনের ছাত্র এবং তিনি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন আইনস্টাইন, প্লাঙ্ক, মেস্ট, ভসলের মতো নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানীদের। আইনস্টাইনের চিঠি পাওয়ার ফলে আমেরিকাতে পরমাণু বোমা তৈরির জন্য বিজ্ঞানীরা একযোগে কাজ শুরু করেন।
১৯৩২ সালের জেমস চ্যাডউইক আবিষ্কার করলেন নিউট্রন। নিউট্রনের কোনো বিদ্যুৎ নেই সেজন্য তার সংখ্যা যতই হোক না কেন পরমাণু বিদ্যুৎ বিচারে নিরপেক্ষ হবে। এ নিউট্রনই হল পরমাণুর কেন্দ্র স্থলের অনাবিষ্কৃত অংশ এবং পরমাণু বিভাজনের মূল উপাদান। এ আবিষ্কারের জন্য চ্যাডউইক ১৯৩৫ সালে নোবেল পুরস্কার পেলেন। এরপরে ইটালির বিজ্ঞানী রোম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিদ্যার প্রধান অধ্যাপক এনরিকো ফার্মি চ্যাডইউকের নব আবিস্কৃত নিউট্রন দিয়ে সবচেয়ে ভারী পদার্থ ইউরেনিয়ামের পরমাণুতে আঘাত করে তাকে বিচূর্ণ করলেন। এটিই হলা পরমাণু বোমা আষ্কিারের শ্রেষ্ঠতম পরীক্ষা। জিওলার্ড এসব বিষয় নিয়ে নিজে কোনো পরীক্ষা না করলেও তিনি বুঝতে পারলেন সর্বনাশ হতে চলেছে। বিজ্ঞানীদের আবিস্কারের মাধ্যমে পরমাণু শক্তির হাতে ভবিষ্যত মানব সমাজের চরম দুর্দশার কথা চিন্তা করে তিনি অন্যান্য বিজ্ঞানীদের কাছে আবেদন করলেন তারা যেন এ বিষয়ে আর কোনো নিবন্ধ বা প্রবন্ধ প্রকাশ না করেন। কারণ তিনি ১৯৩৩ সালে জার্মানীতে হিটলারের যুদ্ধংদেহি মনোভাব প্রত্যক্ষ করেছেন। ভীত হয়ে সর্বপ্রথমে তিনিই জার্মানী ছেড়ে অস্ট্রিয়াতে চলে গিয়েছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন হিটলারের হাত থেকে অস্ট্রিয়াও মুক্তি পাবে না, সেজন্য সেখান থেকে ইংল্যান্ড চলে গিয়েছিলেন। ইংল্রান্ড থেকে পরে তিনি আবার আমেরিকাতে চলে গিয়েছিলেন। ফার্মি ১৯৩৮ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়ে আর ইটালিতে ফিরে যাননি। তিনি আমেরিকাতে জিলার্ডের কাছে চলে গিয়েছিলেন। এ সময় সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী ডেনমার্কের নিলসবোর ১৯৩৯ সালে দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, অতি সামান্য পরিমাণ ইউরেনিয়াম-২৩৫ থেকে যদি আস্তে আস্তে নিউট্রন দিয়ে তার পরমাণুতে আঘাত করা যায় তবে বিস্ফোরণ হতে বাধ্য এবং সে বিস্ফোরণ গবেষণাগারে তার চারপাশের সমস্ত শহর ধ্বংস করে দেবার মতো শক্তিশালী।
জিলার্ড এসব যত শুনছেন, ততই তিনি বিজ্ঞানীদের কাছে দেন-দরবার শরু করছেন। অনুরোধ রাখেছেন। বাস্তব ক্ষেত্রে নিউট্রন দিয়ে পরমাণুর বক্ষ বিদীর্ণ করে যে বিপুল শক্তি তা এখনও আহরিত হয়নি একথা ঠিক, কিন্তু তা আর বেশি দূরে নয়। এ চরম শক্তির কথা যদি কোনো কারণে যুদ্ধমানব হিটলারের কাছে গিয়ে পৌঁছে তাহলে তা হবে মানব সভ্যতার সবচেয়ে সংকটময় দিন। জিলার্ড কুরীতে টেলিগ্রাম করলেন, উত্তর পেলেন অনেক দেরি হয়ে গেছে। জিলার্ড নিজের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা করে দেখলেন ইউরেনিয়ামের পরমাণুকে বিদীর্ণ করে একটি নিউট্রন মুক্ত করা যাচ্ছে। এখন যদি ঐ ধাতুর পরিমাণ বেশি হয় যার ফলে একর পর এক নিউট্রন মুক্ত হবে, তাহলে চক্রবৃদ্ধি হারে বিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে অর্থাৎ চেনরিঅ্যাকশন শুরু হয়ে যাবে। ফল হবে অত্যন্ত শক্তিশারী এক বিস্ফোরণ। জিলার্ড ঠিক করলেন তার প্রথম কাজ হবে ইউরোপের ইউরেনিয়মের মজুদগুলো হিটলারের কাছ থেকে সরিয়ে নিরাপদ স্থানে রাখা। কারণ সবচেয়ে বেশি ইউরেনিয়াম আছে বেলজিয়ামে। আইনস্টাইন তখন আমেররিকাতে বসবাস করছেন। হিটলার তাঁকে জার্মানি থেকে বহিস্কার করেছেন। জিলার্ডের মনে হল তাঁকে সব কথা বুঝিয়ে বললে তিনি হয়তো এর একটি উপায় বের করতে পারবেন। আইনস্টাইন তখন প্রিস্টনে বসবাস করতেন। এ প্রিস্টনেই খাকতেন জিলার্ডের বন্ধু উইগনার।
আইনস্টাইনের সঙ্গে যোগাযোগে করা হলে তিনি জানালেন তাঁরা গ্রীষ্মের ছুটিতে লং আইল্যান্ডে বেড়াতে যাচ্ছেন সেখানে তাঁরা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারেন। এরপর ১৯৩৯ সালের জুলাই মাসে জিলার্ড আর উইগনার লং আইল্যান্ডে গেলেন । আইনস্টাইন তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করলেন। আইনস্টাইনের ইউরেনিয়াম দিয়ে চেইন রিঅ্যাকশনের কথা মনে হয়নি। কিন্তু তিনি তাঁদের কথা শোনামাত্রই এর গুরুত্ব বুঝতে পারলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে জিলার্ডকে সাহার্য সহযোগিতা করতে রাজি হলেন। সিদ্ধান্ত হল আমেরিকার প্রেসিডেন্টের কাছে একটি চিঠি লেখা হবে, যাতে বেলজিয়াম সরকারের সঙ্গে অবিলম্বে যোগাযোগ করে ইউরেনিয়ামের মজুদ ভান্ডার সম্পর্কে সতর্ক করতে অনুরোধ জানানো হয় এবং দ্বিতীয়ত, পরমাণু গবেষণা করার জন্য যাতে অর্থ পাওয়া যায় সেজন্যই আবেদন করলেন। জিলার্ডের প্রধান ভাবনা ছিল কিভাবে চিঠির বক্তব্য আমেরিকার প্রেসিডেন্টের নজরে আনা যায়। সেজন্য তিনি অনেক বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। সে সময় আলেকজান্ডার স্যাকস নামক এক ধনীর সঙ্গে জিলার্ডের পরিচয় হল। স্যাকস ছিলেন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের বন্ধু। ঠিক হল আলেকজান্ডার চিঠিটি নিজে প্রেসিডেন্টের হাতে দিয়ে আসবেন। আলেকজান্ডার ১৯৩৯ সালের ১১ অক্টোবর জিলার্ডের ড্রাফট করা এবং আইনস্টানের সই করা চিঠিটি প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের কাছে দিয়ে গিয়েছিলেন। আলেকজান্ডার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য চিঠিটি প্রেসিডেন্টের সামনে জোরে জোরে পড়তে লাগলেন। চিঠির দীর্ঘ বক্তব্য শুনে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট খুব একটা খুশি হতে পারলেন না। চিঠিটি পড়া শেষ হলে তিনি হেসে বললেন, খুবই বিচিত্র এ চিঠি। কিন্তু তার সরকার থেকে এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হবে না। আলেকজান্ডার এ ভয়ই করেছিলেন। তিনি হতাশ হয়ে ফেরার আগে প্রেসিডেন্টের কাছে পরের দিন আবার কথা বলার জন্য সময় দিতে বললেন। আলেকজান্ডার বুঝতে পারলেন তাকে সান্তনা দেয়ার জন্যই প্রেসিডেন্ট তার প্রাতরাসের সময় আলেকজান্ডারকে পরদিন আবার সময় দিলেন। আলেকজান্ডার পরদিন সকালে রুজভেল্টের সাথে দেখা করতে গেলেন। প্রেসিডেন্ট তখন আলেকজান্ডারকে ঠাট্টা করে বললেন, বলুন। আবার কি নতুন খবর এনেছেন? কত সময় লাগবে আপনার ? আলেকজান্ডার বললেন, বেশি সময় নেব না। তবে এবার কোনো চিঠি পাঠ করবো না - আমি আপনাকে একটি গল্প শোনাবো। আলেকজান্ডার তার গল্প শরু করলেন, বললেন, ফরাসী সম্রাট নেপোলিয়নের কথা। ট্রাফালগার যুদ্ধের ঠিক আগের কথা। সমস্ত ইউরোপ তখন নেপোলিয়নের দখলে, বাকি শধু ইংল্যান্ড। নেপোলিন ইংশিল চ্যানেল অতিক্রম করে ইংল্যান্ড আক্রমণে ব্যস্ত। এমন সময় একজন আমেরিকান বিজ্ঞানী এসে নেপোলিয়নের সাক্ষাৎ প্রার্থনা করলেন। অনেক চেষ্টায় তিনি নেপোলিয়নের সাথে দেখা করে জানালেন তিনি এক ধরনের বাষ্পচালিত জাহাজ তৈরি করতে পারেন, যাতে পালের প্রয়োজন হয় না। এছাড়া খারাপ অবহাওয়াতেও তা সুন্দরভাবে চলতে পারে। নেপোলিয়ন বিস্ময়ের সঙ্গে প্রশ্ন করেছিলেন -পাল ছাড়া জাহাজ? খুবই অবাক হওয়ার বিষয়।
বৃটিশ ইতিহাসবিদ লর্ড এ্যকটন বলেছিলেন, ইংল্যান্ড সেই সময় কিভাবে নেপোলিয়নের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলো। তিনি লিখেছেন, যদি সেদিন নেপোলিয়ন একটু দূরদর্শিতার পরিচয় দিতেন এবং ঐ বিজ্ঞানীর কথামতো কাজ করতেন তবে ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হত। প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডারের গল্প শুনে অনেক্ষণ চুপ করে বসে থাকলেন। তারপর কাগজে কিছু একটা লিখে য়োরার হাতে দিলেন। লোকটি ভেতরে গিয়ে একটি ওয়াইনের বোতল নিয়ে ফিরে এল- নেপোলিয়নের সময়ে তৈরি ফরাসী ওয়াইন প্রেসিডেন্টের পারিবারিক পানীয়। প্রেসিডেন্ট গভীর চিন্তার মগ্ন-ইঙ্গিতে বেয়ারাকে দুই গ্লাসে ঐ ওয়াইন দিতে বললেন। একটি আলেকজান্ডারের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে অন্যটি নিজে তুলে নিলেন এবং আলেকজান্ডারের দিকে মাথা নেড়ে পান করলেন। তারপর নীরবতা ভঙ্গ করে আলেকজান্ডারের দিকে তাকিয়ে বললেন-আলেকজান্ডার আপনি কি এ কথাই আমাকে বলতে চান যে ন্যাৎসীরা যেন আমাদের পারমাণিবিক বোমায় উড়িয়ে না দেয় ? আলেকজান্ডার বললো, ঠিকই বলেছেন আপনি। এবার প্রেসিডেন্ট সচেতন হলেন এবং তার মিলিটারি অ্যাটাশে জেনালের ওয়াটসনকে ডেকে পাঠালেন। ওয়াটসন প্রেসিডেন্টের কাছে আসলে আলেকজান্ডারের আনা চিঠিগুলো মিলিটারি অটাশের হাতে দিয়ে বললেন, খুব দ্রুত ব্যবস্থা নিন। আইনস্টাইনের ঐ চিঠিই আমেরিকাকে সচেতন করে তুললো। এরপর দ্রুতগতিতে চললো পারমাণবিক বোমা তৈরির কাজ। আমেরিকার সেরা বিজ্ঞানীদের একসঙ্গে করে প্রায় দুশো কোটি টাকা খরচ করে লসঅ্যাঞ্জেলস এর মেক্সিকোর এক নির্জন স্থানে গড়ে তোলা হল এক বিশাল গবেষণা কেন্দ্র-ম্যানহাট্রান প্রোজেক্ট।
প্রথম পারমাণবিক বোমা পরীক্ষা করা হয় লসঅ্যাঞ্জেলস এর কাছে এক মরুভূমিতে ১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই ভোর ৫টা ৩০ মিনিটে। পরের দুটি বোমা পরীক্ষা করা হয়েছিলো জাপানে ৬ আগস্ট হিরেশিমা এবং ৯ আগস্ট নাগাসাকিতে। দুটি শহরে বিলীন হয়ে গিয়েছিলো মানব সভ্যতার মানচিত্র থেকে।
শফি ইসলাম
No comments:
Post a Comment