পদ্মা সেতু প্রকল্প
পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের ১৪ শতাংশ কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। এর বেশির ভাগই সংযোগ সড়ক, পুনর্বাসন ও প্রকল্প এলাকার উন্নয়নকাজ। এখন শুরু হয়েছে মূল সেতু নির্মাণের কাজ।
সেতু বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, গত অক্টোবর পর্যন্ত প্রকল্পের মাওয়া সংযোগ সড়কের কাজের অগ্রগতি হয়েছে ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ। জাজিরার সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণকাজের অগ্রগতি হয়েছে যথাক্রমে ২০ দশমিক ৫ ও ১০ দশমিক ৫৬ শতাংশ। মূল সেতু ও নদীশাসনের কাজ এগিয়ে গেলে অগ্রগতির হার আরও বেড়ে যাবে বলে প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এখন মূল সেতুর জন্য নদীর বিভিন্ন অংশে মাটি পরীক্ষা চলছে। এরপর হবে পরীক্ষামূলক পাইলিংয়ের (ভিত্তি) কাজ। এর বাইরে প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ মুন্সিগঞ্জ, শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলা প্রশাসনকে দেওয়া হয়েছে এক হাজার ৭০ কোটি টাকা। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের জন্য প্লট তৈরি করা হয়েছে দুই হাজার ৫৯২টি। অক্টোবর পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ৭৯০টি প্লট হস্তান্তর করা হয়েছে। ২০১৮ সালে সেতু দিয়ে যুগপৎভাবে যানবাহন ও ট্রেন চলাচল করবে—এই পরিকল্পনা নিয়েই এগোচ্ছে সবকিছু। সম্প্রতি প্রকল্পের মাওয়া অংশে গিয়ে দেখা যায়, পদ্মার দুই পাড়ে কর্মযজ্ঞ চলছে। মাওয়ায় বড় বড় বার্জে ক্রেন বসানো হয়েছে নির্মাণসামগ্রী ওঠানো-নামানোর জন্য। বড় বড় যন্ত্রে মাটি কাটা ও সমান করা হচ্ছে। চলছে সড়ক নির্মাণ ও সম্প্রসারণের কাজ। পাড়ে গাছ কাটা হচ্ছে। নদীতে চলছে ড্রেজার। মানুষ আসছে চাকরির খোঁজে, ব্যবসার আশায়। নির্মাণ অঙ্গনে (কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড) শ্রমিক ও কর্মকর্তাদের থাকার জন্য প্রায় এক কিলোমিটার লম্বা ঘর বানানো হচ্ছে। কয়েক শ শ্রমিক সেখানে কাজ করছেন। কেউ ইট ভাঙছেন। কেউ ভবন বানাচ্ছেন। নিরাপত্তা হেলমেট পরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা নির্দেশনা দিচ্ছেন। একই রকম কর্মমুখর পরিবেশ শরীয়তপুরের জাজিরা ও শিবচরে। সেখানে সীমানাপ্রাচীর দিয়ে পাথর-বালু-ইট এনে স্তূপ করে রাখা হচ্ছে। একটু পর পর ইট-বালু-সিমেন্ট-পাথর-মাটি নিয়ে বড় বড় ট্রাক প্রবেশ করছে নির্মাণ এলাকায়। বড় বড় যন্ত্র দিয়ে মাটি সমান করার কাজ চলছে। পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীন সেতু বিভাগ। ওই বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সরকার পদ্মা সেতু নির্মাণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিয়মিত কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছেন। পদ্মা সেতু প্রকল্পের সমীক্ষা হয়েছিল জাপানি সংস্থা জাইকার অর্থে। নকশা প্রণয়ন করা হয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে। মূল প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাইকা ও ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে দাতারা সরে যাওয়ার ঘোষণা দিলে জটিলতা তৈরি হয়। একপর্যায়ে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়। রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় ডলার জোগান দেওয়ার নিশ্চয়তা দেয়। পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। দ্বিতলবিশিষ্ট এই সেতু নির্মিত হবে কংক্রিট আর স্টিল দিয়ে। ওপর দিয়ে যানবাহন আর নিচ দিয়ে চলবে ট্রেন। সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মূল সেতু ও নদীশাসনের কাজ চার বছরের মধ্যে শেষ করার সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে ঠিকাদারদের। তবে বড় ধরনের কারিগরি সমস্যা কিংবা রাজনৈতিক বিপর্যয় নেমে না এলে নির্ধারিত সময়ের আগেই কাজ শেষ করার আশ্বাস দিয়েছেন ঠিকাদারেরা। সংযোগ সড়ক ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণকাজের জন্য সাড়ে তিন বছর সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। কাজ তদারকির জন্য একদল কর্মকর্তা প্রকল্প এলাকায় অবস্থান করছেন। আর বনানীর সেতু ভবনে যাঁরা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে রয়েছেন, তাঁরাও বন্ধের দিন প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করছেন। জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, পদ্মা সেতু এখন আর কোনো স্বপ্ন নয়, দৃশ্যমান বাস্তবতা। বড় বড় চ্যালেঞ্জ পাড়ি দিতে হয়েছে। এখন শুধু কাজ। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হবে। ২০১৮ সালে ট্রেন ও যানবাহন চলবে। তিনি বলেন, ‘এই প্রকল্পে দুর্নীতি-অনিয়মের ব্যাপারে শূন্য সহনশীলতা (জিরো টলারেন্স) দেখানো হবে। শতভাগ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাই মূল লক্ষ্য।’ স্বপ্নের খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে আসছে পদ্মা সেতু পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ ছয় ভাগে (প্যাকেজ) ভাগ করা হয়েছে। পাঁচটি ভৌত কাজের এবং একটি তদারকি পরামর্শকসংক্রান্ত। ভৌত কাজগুলো হলো মূল সেতু, নদীশাসন, দুই পাড়ে সংযোগ সড়ক নির্মাণ ও অন্যান্য অবকাঠামো। এসব কাজ তদারকির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দুটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে। মূল সেতু নির্মাণে গত জুনে চীনের চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি ইতিমধ্যে ভারী যন্ত্রপাতি নিয়ে প্রকল্প এলাকায় অবস্থান নিয়েছে। প্রকল্পের কাজ তদারকির দায়িত্বে রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার কোরিয়ান এক্সপ্রেসওয়ে ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। জানতে চাইলে পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, নির্মাণ পর্যায়ে কারিগরি নানা জটিল বিষয় আসতে পারে। তবে সবকিছুই ঠিকঠাকমতো এগোচ্ছে। কাজ নির্ধারিত সময়েই শেষ হবে বলে আশা করা যায়। পাঁচটি ভৌত ও দুটি তদারক প্যাকেজ মিলিয়ে এখন পর্যন্ত প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৭৭ কোটি টাকা। নদীর তীর রক্ষা, ফেরিঘাট সরানো ও নিরাপত্তাব্যবস্থা রক্ষার ব্যয় ধরলে তা ২৫ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছাবে। সব ব্যয় অন্তর্ভুক্ত করে প্রকল্প প্রস্তাব আবার সংশোধন করতে হবে বলে সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। ভৌত কাজের ঠিকাদারদের প্রত্যেককে শুরুতেই চুক্তিমূল্যের ১৫ শতাংশ হারে অগ্রিম অর্থ দেওয়া হয়েছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে ১০ শতাংশ। সব আন্তর্জাতিক দরপত্রেই যন্ত্রপাতি সংগ্রহ ও প্রকল্প এলাকার উন্নয়নের জন্য অগ্রিম অর্থ দেওয়ার নিয়ম আছে। আন্তর্জাতিক দরপত্রে ঠিকাদারের পাওনার একটি বড় অংশ ডলারে পরিশোধ করতে হয়। এটা চুক্তির সময় উল্লেখও থাকে। পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রায় ৭০ শতাংশ পাওনা ডলারে পরিশোধ করতে হবে বলে সেতু বিভাগ সূত্র জানিয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ২০০৭ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) প্রায় ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকায় প্রথম পদ্মা সেতু প্রকল্পটি অনুমোদন করেছিল। ২০১১ সালে প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করে ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, সরকারিভাবে এখনো ২০১১ সালে ধরা ব্যয়ই বহাল আছে। সেতু বিভাগ থেকে গত এপ্রিলের শেষের দিকে পরিকল্পনা কমিশনে চিঠি দিয়ে প্রকল্প সংশোধনসংক্রান্ত নির্দেশনা থেকে পদ্মা সেতু প্রকল্পকে অব্যাহতি দেওয়ার অনুরোধ করা হয়। উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ও সংশোধনসংক্রান্ত সরকারের পরিপত্র অনুসারে একটি প্রকল্প সর্বোচ্চ দুবার সংশোধন করা যাবে। তৃতীয়বার করা যাবে পরিকল্পনামন্ত্রীর বিশেষ বিবেচনায়। সরকারের একটি সূত্র জানায়, দুই কারণে সরকার এই প্রকল্পটিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রথমত, এর অর্থায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের সঙ্গে সরকারের তিক্ততার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এটাকে সরকার চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। পাশাপাশি এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বিশ্বের সামনে বাংলাদেশের সক্ষমতাকেও তুলে ধরতে চায় সরকার। দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে ২০০৮ সালে। আগামী নির্বাচনে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের কাছে রাজনৈতিকভাবে সরকার বিশেষ সুবিধা পাবে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে। এ প্রকল্পের বিষয়ে সরকারের স্পর্শকাতরতার উদাহরণ দিতে গিয়ে সেতু বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, মাওয়া ফেরিঘাট সরানোর জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কয়েকবার তাগিদ দিয়েছে। এরপর গত ২০ নভেম্বরের মধ্যে ঘাট সরানোর সময় বেঁধে দেওয়া হয় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআইডব্লিউটিএ)। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে তারা ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় চায়। এটা জেনে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় তাৎক্ষণিক ঘাট সরানোর নির্দেশ দেয় এবং ২৭ নভেম্বরই ঘাট সরানো হয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এও জানান, প্রধানমন্ত্রী বিদেশে সফরে গেলে এসেই প্রথমে পদ্মা সেতুর কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে সর্বশেষ তথ্য সংগ্রহ করেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন। পদ্মা সেতু : স্বপ্ন ও বাস্তবতা : কাজ শুরুর আগেই সাড়ে ৮শ’ কোটি টাকা ব্যয়, আড়াই বছর কেটে গেছে ভাগবাটোয়ারা নিয়ে 14 September 2011 at 22:51 পদ্মা সেতু : স্বপ্ন ও বাস্তবতা : কাজ শুরুর আগেই সাড়ে ৮শ’ কোটি টাকা ব্যয়, আড়াই বছর কেটে গেছে ভাগবাটোয়ারা নিয়ে, দুর্নীতিতে অনেক ক্ষমতাধর ব্যক্তি জড়িত কাদের গনি চৌধুরী পদ্মা সেতুর স্বপ্ন কবে পূরণ হবে—এ ব্যাপারে কেউ নিশ্চিত নন। নির্বাচনের আগে ও সরকার গঠনের পর আওয়ামী লীগ নেতারা দেশের মানুষকে যেসব স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম ছিল পদ্মা সেতু। গত পৌনে ৩ বছরে প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও যোগাযোগমন্ত্রী অসংখ্যবার পদ্মা সেতুর কাজ শুরু এবং এ সরকারের আমলেই সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দিয়ে জনগণের করতালিও আদায় করে নেন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন। জোরেশোরে পদ্মা সেতুর কাজ শুরুর কথা বলে নির্মাণ ব্যয়ও বাড়ানো হয়েছে আড়াইগুণ। এরই মধ্যে সরকারের মেয়াদ অর্ধেক পেরিয়ে গেলেও এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের কিছুই হয়নি। এখন আনুষ্ঠানিকভাবেই এ সরকারের আমলে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হবে না বলে জানানো হয়েছে। দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে ঋণদাতা সংস্থাগুলোর কঠোর অবস্থানের কারণেই এমনটা হয়েছে বলে অর্থমন্ত্রী স্বীকার করেছেন। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২৯০ কোটি ডলার ব্যয়ে নির্মিতব্য দেশের দীর্ঘতম পদ্মা সেতুর জন্য বাংলাদেশের ২৫ কোটি ৭০ লাখ ডলার ছাড়া বাদবাকি অর্থ জোগান দেয়ার কথা ছিল বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ (এডিবি) বিভিন্ন ঋণদাতা সংস্থা। ঢাকঢোল পিটিয়ে শুরু করা এই সেতু প্রকল্পের কাজে এখন পর্যন্ত সরকারের ব্যয় হয়েছে ৮৫০ কোটি টাকারও বেশি। তবে এর নির্মাণ কাজ শুরুর আগেই বিপত্তি দেখা দিয়েছে। সেতু নির্মাণে তদারকি ও পরামর্শক কাজের জন্য দরদাতা একটি কানাডিয়ান পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণের অভিযোগ তুলেছে প্রধান ঋণদাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক। এ নিয়ে তাদের পক্ষ থেকে তদন্ত শুরুর আহ্বানও জানানো হয়েছে। এ জটিলতার কারণে ঋণের অর্থ ছাড় দিতে অস্বীকার করায় সেতু প্রকল্পের কাজ থমকে দাঁড়ানোর কথা বলা হয়েছে। এমন অবস্থায় দুর্নীতিগ্রস্ত কোনো প্রতিষ্ঠানকে পদ্মা সেতু প্রকল্পে নিয়োগ দেয়া হবে না বলে সরকারের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা করা হয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দেয়া ও নিজেদের গা বাঁচানোর জন্যই যে এমনটা করতে হয়েছে—সেটা সবাই বুঝে গেছে। সংবাদ সম্মেলনে প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের চেয়ারম্যানের উপস্থিত না থাকার ঘটনা সেটাই প্রমাণ করে। ফলে এ প্রকল্প নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ খণ্ডন করে স্বচ্ছতা প্রমাণের সর্বশেষ প্রচেষ্টাও ভেস্তে যেতে বসেছে। তাছাড়া পদ্মা সেতুর টেন্ডার ডকুমেন্টে এডিবির দুর্নীতিবিরোধী নীতিমালা ও ঠিকাদার নিয়োগে প্রযোজ্য শর্ত যুক্ত করা নিয়েও ঋণদাতা সংস্থাগুলো এবং সরকারের মধ্যে মতবিরোধ জটিল আকার নিয়েছে বলে জানা গেছে। এর মীমাংসা না হওয়ায় পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ শুরু নিয়ে অনিশ্চয়তা দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এসব নিয়ে যোগাযোগমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টার দৌড়-ঝাঁপের ফলাফল এখন পর্যন্ত শূন্য। দেশের সড়ক যোগাযোগের নজিরবিহীন বিপর্যয় যোগাযোগমন্ত্রীকে যখন ঘরে-বাইরে কোণঠাসা করে ফেলেছে, ঠিক তখনই পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ পূর্বঘোষণা মোতাবেক শেষ করতে না পারার স্বীকারোক্তি তার অযোগ্যতাকে আরও বড় করে তুলেছে। একইসঙ্গে এটি সরব সরকারের ব্যর্থতার মুকুটে আরেকটি পালক যুক্ত করার শামিল। ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই দুর্নীতি, অনিয়ম, অযোগ্যতার সব প্রশ্নেই ক্ষমতাসীনরা আগের জোট সরকারকে দায়ী করেছে, গালাগাল করে মুখে ফেনা তুলেছে; এখন দেখা যাচ্ছে তারা নিজেরাই সেসব অভিযোগে অভিযুক্ত। বার বার হোঁচট খাচ্ছে : বার বার হোঁচট খাচ্ছে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ। ভাগবাটোয়ারা নিয়ে কিনারা করতে না পারায় একের পর এক জটিলতা তৈরি হচ্ছে। হঠাত্ করে প্রকল্প ব্যয় আড়াইগুণ বৃদ্ধির পর থেকেই এ প্রকল্পের স্বচ্ছতা নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। বিশ্বব্যাংক দুর্নীতি আঁচ করতে পেরে প্রথম থেকেই এ প্রকল্পে অধিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা দাবি করে আসছিল। কাজ শুরুর আগেই জমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিপূরণ প্রদান, পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখিও হয়। এক পর্যায়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) পদ্মা সেতু নির্মাণকে ঘিরে দুর্নীতির আশঙ্কা অনুধাবন করে ২০০৯ সালের জুলাই মাসে ‘সততা চুক্তির রূপরেখা’ শিরোনামে একটি প্রস্তাব যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। এতে মন্ত্রণালয় এবং দরপত্রে অংশগ্রহণকারী পক্ষগুলোকে সম্পৃক্ত করে এ ধরনের একটি চুক্তি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সহযোগিতার প্রস্তাব করা হলেও মন্ত্রণালয়ের কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে টিআইবি। এদিকে এক ভোজসভায় যোগাযোগমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে ঢাকা থেকে ওয়াশিংটনে পাঠানো যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টির একটি গোপন বার্তা গত ৩০ আগস্ট প্রকাশ করে দেয় জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের হৈচৈ ফেলে দেয়া ওয়েবসাইট উইকিলিকস। আবুল হোসেনের ‘রেপুটেশন লেস দেন অনেস্ট’ উল্লেখ করে ওই বার্তায় বলা হয়, ‘দুর্নীতির অভিযোগ এখনও যোগাযোগমন্ত্রীকে ঘিরে আছে। তিনি যে পদ্ধতিতে কাজ করেন, তার বেশকিছু সমস্যার কথা বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা আমাদের জানিয়েছেন। তাছাড়া চীনের সঙ্গে মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের বিষয়টিও সবার জানা।’ ওই তারবার্তার ভিত্তিতে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলে আবুল হোসেন উইকিলিকসে প্রকাশিত নথির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। নিজেকে ‘পরীক্ষিত সেলাক’ দাবি করে ৪ সেপ্টেম্বর যোগাযোগমন্ত্রী দাবি করেন, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন সংক্রান্ত সব তথ্য টিআইবিতে পাঠানো হয়। কিন্তু সম্প্রতি গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে টিআইবি বলেছে, ‘যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের টেন্ডার সংক্রান্ত কয়েকটি দলিল টিআইবির কাছে ঠিকই পাঠানো হয়েছে। তবে তার ভিত্তিতে পদ্মা সেতু নির্মাণের টেন্ডার প্রক্রিয়া কিংবা যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমের স্বচ্ছতার মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। এরূপ মূল্যায়ন বা সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার বিষয়ে কোনোপ্রকার মন্তব্য করার জন্য যে ধরনের অনুসন্ধান ও সম্পৃক্ততার প্রয়োজন, সে সুযোগ টিআইবির হাতে নেই।’ সেতু বিভাগের একটি সূত্র জানায়, পদ্মা সেতুর কাজে দরপত্রে অংশ নেয়া বিভিন্ন সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে বিশ্বব্যাংকের কাছে। বিশেষ করে তদারকির কাজে প্রাথমিক তালিকায় থাকা একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় পদ্মা সেতুর অর্থায়নে জটিলতা দেখা দিয়েছে। এ সমস্যা সমাধানে বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মধ্যে আলোচনা চলছে। রোববার এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) আবাসিক প্রতিনিধি থেবাকুমার কান্দিয়াহ এক চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের কাছে দুর্নীতির অভিযোগের কথা স্বীকার করেন। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এনইসি সম্মেলন কক্ষে সরকার ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মধ্যে আড়াই কোটি মার্কিন ডলারের এ ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। তিনি বলেন, দুর্নীতি রোধ ও ক্রয়ের (প্রকিউরমেন্ট) ক্ষেত্রে আমাদের নিজস্ব একটি গাইডলাইন আছে, পদ্মা সেতু প্রকল্পে এর প্রয়োগ দেখতে চায় এডিবি। সূত্র জানায়, পদ্মা সেতু প্রকল্পে এসএনসি-লাভালিন গ্রুপ নামের একটি কানাডীয় প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি বিশ্বব্যাংকের অনুরোধে তদন্ত করছে কানাডা। পদ্মা সেতু প্রকল্পের তদারকি প্রতিষ্ঠান নির্বাচনে তৈরি হওয়া সংক্ষিপ্ত তালিকায় এসএনসি-লাভালিন রয়েছে। এ কারণে পদ্মা সেতু প্রকল্প এগিয়ে নিতে দেরি হচ্ছে। শনিবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও একই কথা জানান। এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এডিবির আবাসিক প্রতিনিধি বলেন, এ নিয়ে ম্যানিলা-ওয়াশিংটন করপোরেট লেভেলে আলোচনা হচ্ছে। রোববার অর্থ মন্ত্রণালয়ে বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ইসাবেল এম গেরেরোর সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর বৈঠক হয়। তবে বৈঠকের বিষয়ে কেউই সাংবাদিকদের কিছু বলেননি। অবশ্য অর্থমন্ত্রী আশা করছেন, আগামী জানুয়ারির মধ্যেই পদ্মা সেতু নির্মাণের চূড়ান্ত দরপত্র আহ্বান করা যাবে। সোমবার সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে অর্থমন্ত্রী বলেন, পদ্মা সেতুর কাজে দরপত্রে অংশ নেয়া বিভিন্ন সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে বিশ্বব্যাংকের কাছে। তিনি অভিযুক্ত এসব সংস্থার নাম প্রকাশের অনুরোধ জানিয়েছেন। অর্থমন্ত্রী জানান, অভিযুক্ত কোম্পানির শাস্তি হবে তার দেশের আইনে। আমরা এমন অভিযুক্ত কোম্পানিগুলোকে বাদ দিয়ে কাজ করতে চাই। অভিযোগ প্রমাণ হলো কিনা, তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। এসময় অর্থমন্ত্রীর কাছে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন, যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ বিশ্বব্যাংকের কাছে আছে কিনা। এর জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, এভিডেন্স দেখার পর বিশ্বব্যাংক জানাবে তার (যোগাযোগমন্ত্রীর) বিরুদ্ধে কোনো রিজার্ভেশন আছে কিনা। এর আগে আমি এ বিষয়ে কিছুই বলতে পারব না। অর্থমন্ত্রী বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজের বিষয়টি বিশ্বব্যাংকের কারণে আটকে আছে। সেতু নির্মাণসংশ্লিষ্ট কাজের জন্য শর্টলিস্ট করা সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। কানাডাভিত্তিক একটি সংস্থার বিষয়ে তদন্ত চলছে। আর কয়েকটি সংস্থার বিরুদ্ধে ‘এভিডেন্স’ এসেছে বিশ্বব্যাংকের হাতে। এগুলো নিষ্পত্তি না হওয়ায় সেতু তৈরির কাজ বিলম্ব হচ্ছে। আবুল মাল আবদুল মুহিত জানান, পদ্মা সেতু নির্মাণে পরামর্শক নিয়োগ, সেতুর জন্য টেন্ডার আহ্বান এবং নদীশাসন সংক্রান্ত কাজের অগ্রগতি হচ্ছে না। বিশ্বব্যাংক এ তিনটি বিষয়ে ‘ওকে’ করলে টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরু হবে। আগে আমরা আশা করেছিলাম অক্টোবরে এ প্রক্রিয়া শুরু করতে পারব। এখন মনে হচ্ছে আরও কিছু সময় লাগবে। জানুয়ারির দিকে শুরু করতে পারব। তিনি জানান, বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভায় যোগ দিতে চলতি মাসেই তিনি ওয়াশিংটন যাচ্ছেন। সেখানে বিভিন্ন কোম্পানি সম্পর্কে যেসব অভিযোগ এসেছে, তা নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা হবে। আবুল মাল আবদুল মুহিত সাংবাদিকদের জানান, রোববার বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট একদিনের জন্য ঢাকা সফরে এসেছিলেন। এসময় তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও দেখা করেছেন। অর্থমন্ত্রী জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্টকে বলেছেন, অভিযুক্ত কোম্পানিকে বাদ দিয়েই আমরা কাজ করতে চাই। এজন্য অভিযোগগুলো জানাতে বলেছেন। বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তা অর্থমন্ত্রীকে জানিয়েছেন, অভিযোগ এসেছে। এগুলো তারা দেখছেন। ওয়াশিংটন সফরের সময় এসব বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। কাজ শুরুর যত ঘোষণা : বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার ১৫ দিনের মাথায় পদ্মা সেতু প্রকল্প হাতে নেয়। এরপর থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ১৭ বার কাজ শুরুর সময় ঘোষণা করা হয়। অথচ এখনও কাজ শুরু করা যায়নি। সর্বশেষ ঘোষণাটি আসে ৮ জুলাই। পদ্মাতীরে মাওয়া রেস্টহাউসে সাংবাদিকদের যোগাযোগমন্ত্রী জানান, এ মাসেই পদ্মা সেতুর দরপত্র আহ্বান করা হবে। অন্যান্য প্রক্রিয়া শেষ করে জানুয়ারিতে মূল সেতুর কাজ শুরু হবে। এর আগে ১৩ মার্চ গোপালগঞ্জ সার্কিট হাউস সম্মেলন কক্ষে এক মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন বলেন, আগামী মাসে (এপ্রিল) পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হবে। এছাড়া পদ্মা সেতুর সঙ্গে নির্মিত হবে রেলপথ। সেতু নির্মাণের ১৮ হাজার কোটি টাকা এখন সরকারের হাতে। এর আগে ২০১০ সালের ২২ মে জানান, সেপ্টেম্বরে শুরু হবে পদ্মা সেতুর কাজ। ২৭ সেপ্টেম্বর জানিয়েছিলেন, এ বছরই পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করব। একই বছরের ২০ অক্টোবর তিনি বলেছিলেন, মার্চে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হবে। ২০১১ সালের ১ জুন জাতীয় সংসদে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন বলেছেন, আগামী ২-৩ মাসের মধ্যেই পদ্মা সেতুর চূড়ান্ত কাজ শুরু হবে। তিনি বলেন, এরই মধ্যে মূল সেতু, নদীশাসন, সংযোগ সড়ক এবং ব্রিজ অ্যান্ড ফ্যাসিলিটিজের বিস্তারিত ডিজাইন চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর আগে ৬ এপ্রিল সংসদ ভবনে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভা শেষে তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, চলতি মাসে টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন শেষে জুলাইয়ে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হবে। ১০ এপ্রিল তিনি জানিয়েছিলেন, চলতি মাসেই পদ্মা সেতুর চূড়ান্ত দরপত্র আহ্বান করা হবে। ২০০৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর তিনি জানিয়েছিলেন, ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে পদ্মা সেতু নির্মাণের দরপত্র ডাকা হবে। ওই বছরের ৩০ অক্টোবর তিনি বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণের কার্যাদেশ আগামী বছর দেয়া হবে। ২০১৩ সালের মধ্যে এর নির্মাণ কাজ শেষ হবে। এভাবে ১৭ বার পদ্মা সেতুর কাজ শুরুর সময় ঘোষণা দেন যোগাযোগমন্ত্রী। সরকার ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যে বিরোধের কারণ : পদ্মা সেতু নিয়ে সরকার ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয় মূলত বার বার প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি এবং প্রি-কোয়ালিফিকেশন টেন্ডারে প্রাকযোগ্য বিবেচনা নিয়ে। বিশ্বব্যাংক বলছে, প্রি- কোয়ালিফিকেশন টেন্ডারে প্রাকযোগ্য বিবেচনায় অনিয়ম করেছেন যোগাযোগমন্ত্রী। অপরদিকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় বলছে, পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার ব্যাপারে সম্মত না হওয়ায় বিশ্বব্যাংক কাজের অনুমতি দিতে গড়িমসি করছে। এর ফলে বিশ্বের অন্যতম ব্যয়বহুল এ সেতুটির কাজ কবে শুরু হবে—তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। স্বয়ং যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন এ ব্যাপারে সহযোগিতা চেয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে চিঠি দিয়েছেন। ২১ জুন লেখা এ চিঠিতে বলা হয়, ‘পদ্মা সেতু আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রকল্প। এ প্রকল্প প্রক্রিয়াকরণে সেতু বিভাগ শতভাগ স্বচ্ছতা, দক্ষতা, দ্রুততা, সরকারি নিয়মকানুন ও বিশ্বব্যাংকের গাইডলাইন অনুসরণ করেছে। এতে কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বিশ্বব্যাংকের অনুমতি আদায়ের জন্য যোগাযোগমন্ত্রী অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে সহযোগিতা চেয়েছেন। অর্থমন্ত্রীকে লেখা চিঠির শেষাংশে তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকের প্রক্রিয়াগত বিলম্বের কারণে পদ্মা সেতুর নির্মাণ নিয়ে আশঙ্কার ধূম্রজাল সৃষ্টি করা হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে আমরা মনে করি, পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের সম্মতির বিষয়টি নিয়ে তাদের সঙ্গে আপনার কথা বলা প্রয়োজন। এতে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন কার্যক্রমে অহেতুক বিলম্ব দূর হবে এবং নির্মাণ কাজ শুরুর কার্যক্রম ত্বরান্বিত হবে। এদিকে বিশ্বব্যাংক গত ১৪ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছে, পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থ খরচে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতা দেখতে চায় বিশ্বব্যাংক। তদারকির জন্য একটি স্বতন্ত্র কমিটি গঠনের সুপারিশ করেছে এই উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানটি। বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসে অনুষ্ঠিত এ সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বিশ্বব্যাংকের স্থানীয় কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে এই সুপারিশ করেছেন এবং প্রধানমন্ত্রীও তাদের সুপারিশের পক্ষে মত দিয়েছেন। সরকার ও উন্নয়ন সহযোগীদের বাইরে তৃতীয় পক্ষের বিশেষজ্ঞরা এ দলের সদস্য হিসেবে থাকবেন। বিশ্বব্যাংকের স্থানীয় অফিসে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) অতিরিক্ত সচিব আরাস্তু খান, বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর অ্যালেন গোল্ডস্টেইনসহ বিশ্বব্যাংকের অন্যান্য কর্মকর্তা। তদারকির জন্য স্বতন্ত্র দল গঠন সম্পর্কে অ্যালেন গোল্ডস্টেইন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে; কিন্তু এই অর্থ কীভাবে খরচ হবে—সেটা জানার অধিকার বাংলাদেশের মানুষের রয়েছে। এছাড়া উন্নয়ন সহযোগীরাও চায় অর্থ খরচের প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহির মধ্যে থাকুক। এ সম্পর্কে আরাস্তু খান বলেন, ‘গ্রহণযোগ্যতার জন্য স্বতন্ত্র তদারকি দল গঠনের চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। এ দল গঠিত হলে প্রকল্পের অর্থ ব্যয়ে স্বচ্ছ ও জবাবদিহি থাকবে। এর মানে এই নয় যে, বিশ্বব্যাংক সরকারকে কোনো শর্ত দিচ্ছে। দুর্নীতির ধারণাসূচক অনুযায়ী বলা হয়, বাংলাদেশ অন্যতম দুর্নীতিপরায়ণ দেশ।’ সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ রাখতে তথ্য অধিকার আইন পুরোপুরি অনুসরণ করা হবে। প্রকল্প এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের সঙ্গে পুনর্বাসনসংক্রান্ত জবাবদিহিমূলক বৈঠকও করা হবে। এছাড়া একজন নিরপেক্ষ পরামর্শক নিয়োগ করা হবে, যিনি সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকে প্রতিবেদন দেবেন। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চার দফা পদ্মা সেতুর ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়। জানুয়ারির মাঝামাঝি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণের সর্বশেষ সংশোধিত প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়। সংশোধনের পর এই সেতু নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ২০ হাজার ৫০৭ কোটি ২০ লাখ ১৬ হাজার টাকা। এর আগে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ২০ আগস্ট অনুষ্ঠিত একনেকের বৈঠকে ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ ১০ হাজার টাকা ব্যয় ধরে পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। কাজ শুরুর আগেই প্রকল্প ব্যয় দ্বিগুণ বৃদ্ধি করায় নানা সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে সরকারকে। তাই বিশ্বব্যাংক এ ব্যাপারে বার বার জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার কথা বলে আসছে। বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল সেতু : বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল সেতু বাংলাদেশের পদ্মা সেতু। বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ চীনের হাঙজু বে ব্রিজের দ্বিগুণ ব্যয় ধরা হয়েছে এ সেতুর জন্য। অথচ বাংলাদেশের এ সেতুর চেয়ে হাঙজু বে ব্রিজ প্রায় ছয়গুণ বড়। মাত্র দু’বছর আগে হাঙজু সেতুর কাজ শেষ হয়েছে। হাঙজু বে ব্রিজ ৩৬ কিলোমিটার দীর্ঘ। আর পদ্মা সেতু মাত্র ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। কেউ হিসাব মেলাতে পারছেন না কেন এত অস্বাভাবিক ব্যয় ধরা হলো পদ্মা সেতুর? এ নিয়ে হৈচৈ পড়ে যায় দেশজুড়ে। বাংলাদেশের বৃহত্তম সেতু হিসেবে পদ্মা সেতু নির্মাণের সর্বশেষ ব্যয় ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১০ সালের ২৯ ডিসেম্বর তৃতীয় বুড়িগঙ্গা সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনকালে তিনি জানান, পদ্মা সেতু নির্মাণে ব্যয় হবে ২৬০ কোটি মার্কিন ডলার বা ১৮ হাজার ২শ’ কোটি টাকা। এর মাত্র ১০ দিন আগে ২১ ডিসেম্বর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বিষয়ক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের জানান, এ সেতু নির্মাণে ব্যয় হবে ২৪০ কোটি মার্কিন ডলার বা ১৬ হাজার ৮শ’ কোটি টাকা। অক্টোবরে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণে ব্যয় হবে ১৯০ কোটি মার্কিন ডলার। ২০০৭ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা বা ১৪৭ কোটি ২৭ লাখ ডলারে প্রথম প্রকল্পটি অনুমোদন করেছিল। বলা হয়েছিল, ২০১৫ সালের মধ্যে সেতু তৈরি হবে। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন্স এজেন্সির (জাইকা) সুপারিশ মেনে ২০০৪ সালে মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টে স্থিরকৃত পদ্মা সেতু নির্মাণে সম্ভাব্য ব্যয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ধরা হয়েছিল ১৪০ কোটি ডলার। অর্থাত্ নির্মাণ ব্যয় বেড়ে গেছে দ্বিগুণ। সর্বশেষ এ বছরের ১০ জানুয়ারি একনেকে পদ্মা সেতুর ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি ২০ লাখ ১৬ হাজার টাকা। মাওয়া থেকে জাজিরা পর্যন্ত চার লেনবিশিষ্ট পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ২৩ দশমিক ৬ মিটার। দ্বিতল এ সেতুর ওপরে সড়ক আর নিচ দিয়ে যাবে রেলপথ। অথচ আধুনিক স্থাপত্যবিদ্যার অসাধারণ নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃত চীনের হাঙজু ব্রিজ নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১৭০ কোটি মার্কিন ডলার। এ ব্রিজের দৈর্ঘ্য ৩৬ কিলোমিটার। যা পদ্মা সেতুর চেয়ে প্রায় ছয়গুণ বড়। তাছাড়া পদ্মা সেতু তৈরি হচ্ছে নদীর ওপর; আর হাংজু তৈরি করা হয়েছে সাগরের বুক চিরে। চীনের হাঙজু উপসাগরের ওপর ৩৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু সাড়ে তিন বছরে শেষ করে ২০০৯ সালে সেতুটি উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। অনিয়মে অনেক রাঘববোয়াল জড়িত : যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, পদ্মা সেতুর অনিয়মে শুধু যোগাযোগমন্ত্রী একাই জড়িত নন। এর সঙ্গে সরকারের বাইরের ক্ষমতাধর ব্যক্তিরাও জড়িত আছেন। যারা যোগাযোগমন্ত্রীর মন্ত্রিত্ব রক্ষায় সহায়তা করছেন। সূত্র জানায়, ব্যর্থতা ও দুর্নীতির অভিযোগে সরকারি দল, বিরোধী দল, সুশীল সমাজ যেভাবে যোগাযোগমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করে আসছে, এটি বাংলাদেশে নজিরবিহীন ঘটনা। অথচ এরপরও তিনি বহালতবিয়তে টিকে আছেন পেছনের শক্তির কারণে। আর ওই শক্তির ওপর ভর করেই তিনি একের পর এক অনিয়ম করেই চলেছেন।
সেতু বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, গত অক্টোবর পর্যন্ত প্রকল্পের মাওয়া সংযোগ সড়কের কাজের অগ্রগতি হয়েছে ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ। জাজিরার সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণকাজের অগ্রগতি হয়েছে যথাক্রমে ২০ দশমিক ৫ ও ১০ দশমিক ৫৬ শতাংশ। মূল সেতু ও নদীশাসনের কাজ এগিয়ে গেলে অগ্রগতির হার আরও বেড়ে যাবে বলে প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এখন মূল সেতুর জন্য নদীর বিভিন্ন অংশে মাটি পরীক্ষা চলছে। এরপর হবে পরীক্ষামূলক পাইলিংয়ের (ভিত্তি) কাজ। এর বাইরে প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ মুন্সিগঞ্জ, শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলা প্রশাসনকে দেওয়া হয়েছে এক হাজার ৭০ কোটি টাকা। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের জন্য প্লট তৈরি করা হয়েছে দুই হাজার ৫৯২টি। অক্টোবর পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ৭৯০টি প্লট হস্তান্তর করা হয়েছে। ২০১৮ সালে সেতু দিয়ে যুগপৎভাবে যানবাহন ও ট্রেন চলাচল করবে—এই পরিকল্পনা নিয়েই এগোচ্ছে সবকিছু। সম্প্রতি প্রকল্পের মাওয়া অংশে গিয়ে দেখা যায়, পদ্মার দুই পাড়ে কর্মযজ্ঞ চলছে। মাওয়ায় বড় বড় বার্জে ক্রেন বসানো হয়েছে নির্মাণসামগ্রী ওঠানো-নামানোর জন্য। বড় বড় যন্ত্রে মাটি কাটা ও সমান করা হচ্ছে। চলছে সড়ক নির্মাণ ও সম্প্রসারণের কাজ। পাড়ে গাছ কাটা হচ্ছে। নদীতে চলছে ড্রেজার। মানুষ আসছে চাকরির খোঁজে, ব্যবসার আশায়। নির্মাণ অঙ্গনে (কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড) শ্রমিক ও কর্মকর্তাদের থাকার জন্য প্রায় এক কিলোমিটার লম্বা ঘর বানানো হচ্ছে। কয়েক শ শ্রমিক সেখানে কাজ করছেন। কেউ ইট ভাঙছেন। কেউ ভবন বানাচ্ছেন। নিরাপত্তা হেলমেট পরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা নির্দেশনা দিচ্ছেন। একই রকম কর্মমুখর পরিবেশ শরীয়তপুরের জাজিরা ও শিবচরে। সেখানে সীমানাপ্রাচীর দিয়ে পাথর-বালু-ইট এনে স্তূপ করে রাখা হচ্ছে। একটু পর পর ইট-বালু-সিমেন্ট-পাথর-মাটি নিয়ে বড় বড় ট্রাক প্রবেশ করছে নির্মাণ এলাকায়। বড় বড় যন্ত্র দিয়ে মাটি সমান করার কাজ চলছে। পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীন সেতু বিভাগ। ওই বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সরকার পদ্মা সেতু নির্মাণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিয়মিত কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছেন। পদ্মা সেতু প্রকল্পের সমীক্ষা হয়েছিল জাপানি সংস্থা জাইকার অর্থে। নকশা প্রণয়ন করা হয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে। মূল প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাইকা ও ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে দাতারা সরে যাওয়ার ঘোষণা দিলে জটিলতা তৈরি হয়। একপর্যায়ে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়। রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় ডলার জোগান দেওয়ার নিশ্চয়তা দেয়। পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। দ্বিতলবিশিষ্ট এই সেতু নির্মিত হবে কংক্রিট আর স্টিল দিয়ে। ওপর দিয়ে যানবাহন আর নিচ দিয়ে চলবে ট্রেন। সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মূল সেতু ও নদীশাসনের কাজ চার বছরের মধ্যে শেষ করার সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে ঠিকাদারদের। তবে বড় ধরনের কারিগরি সমস্যা কিংবা রাজনৈতিক বিপর্যয় নেমে না এলে নির্ধারিত সময়ের আগেই কাজ শেষ করার আশ্বাস দিয়েছেন ঠিকাদারেরা। সংযোগ সড়ক ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণকাজের জন্য সাড়ে তিন বছর সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। কাজ তদারকির জন্য একদল কর্মকর্তা প্রকল্প এলাকায় অবস্থান করছেন। আর বনানীর সেতু ভবনে যাঁরা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে রয়েছেন, তাঁরাও বন্ধের দিন প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করছেন। জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, পদ্মা সেতু এখন আর কোনো স্বপ্ন নয়, দৃশ্যমান বাস্তবতা। বড় বড় চ্যালেঞ্জ পাড়ি দিতে হয়েছে। এখন শুধু কাজ। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হবে। ২০১৮ সালে ট্রেন ও যানবাহন চলবে। তিনি বলেন, ‘এই প্রকল্পে দুর্নীতি-অনিয়মের ব্যাপারে শূন্য সহনশীলতা (জিরো টলারেন্স) দেখানো হবে। শতভাগ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাই মূল লক্ষ্য।’ স্বপ্নের খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে আসছে পদ্মা সেতু পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ ছয় ভাগে (প্যাকেজ) ভাগ করা হয়েছে। পাঁচটি ভৌত কাজের এবং একটি তদারকি পরামর্শকসংক্রান্ত। ভৌত কাজগুলো হলো মূল সেতু, নদীশাসন, দুই পাড়ে সংযোগ সড়ক নির্মাণ ও অন্যান্য অবকাঠামো। এসব কাজ তদারকির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দুটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে। মূল সেতু নির্মাণে গত জুনে চীনের চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি ইতিমধ্যে ভারী যন্ত্রপাতি নিয়ে প্রকল্প এলাকায় অবস্থান নিয়েছে। প্রকল্পের কাজ তদারকির দায়িত্বে রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার কোরিয়ান এক্সপ্রেসওয়ে ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। জানতে চাইলে পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, নির্মাণ পর্যায়ে কারিগরি নানা জটিল বিষয় আসতে পারে। তবে সবকিছুই ঠিকঠাকমতো এগোচ্ছে। কাজ নির্ধারিত সময়েই শেষ হবে বলে আশা করা যায়। পাঁচটি ভৌত ও দুটি তদারক প্যাকেজ মিলিয়ে এখন পর্যন্ত প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৭৭ কোটি টাকা। নদীর তীর রক্ষা, ফেরিঘাট সরানো ও নিরাপত্তাব্যবস্থা রক্ষার ব্যয় ধরলে তা ২৫ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছাবে। সব ব্যয় অন্তর্ভুক্ত করে প্রকল্প প্রস্তাব আবার সংশোধন করতে হবে বলে সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। ভৌত কাজের ঠিকাদারদের প্রত্যেককে শুরুতেই চুক্তিমূল্যের ১৫ শতাংশ হারে অগ্রিম অর্থ দেওয়া হয়েছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে ১০ শতাংশ। সব আন্তর্জাতিক দরপত্রেই যন্ত্রপাতি সংগ্রহ ও প্রকল্প এলাকার উন্নয়নের জন্য অগ্রিম অর্থ দেওয়ার নিয়ম আছে। আন্তর্জাতিক দরপত্রে ঠিকাদারের পাওনার একটি বড় অংশ ডলারে পরিশোধ করতে হয়। এটা চুক্তির সময় উল্লেখও থাকে। পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রায় ৭০ শতাংশ পাওনা ডলারে পরিশোধ করতে হবে বলে সেতু বিভাগ সূত্র জানিয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ২০০৭ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) প্রায় ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকায় প্রথম পদ্মা সেতু প্রকল্পটি অনুমোদন করেছিল। ২০১১ সালে প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করে ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, সরকারিভাবে এখনো ২০১১ সালে ধরা ব্যয়ই বহাল আছে। সেতু বিভাগ থেকে গত এপ্রিলের শেষের দিকে পরিকল্পনা কমিশনে চিঠি দিয়ে প্রকল্প সংশোধনসংক্রান্ত নির্দেশনা থেকে পদ্মা সেতু প্রকল্পকে অব্যাহতি দেওয়ার অনুরোধ করা হয়। উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ও সংশোধনসংক্রান্ত সরকারের পরিপত্র অনুসারে একটি প্রকল্প সর্বোচ্চ দুবার সংশোধন করা যাবে। তৃতীয়বার করা যাবে পরিকল্পনামন্ত্রীর বিশেষ বিবেচনায়। সরকারের একটি সূত্র জানায়, দুই কারণে সরকার এই প্রকল্পটিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রথমত, এর অর্থায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের সঙ্গে সরকারের তিক্ততার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এটাকে সরকার চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। পাশাপাশি এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বিশ্বের সামনে বাংলাদেশের সক্ষমতাকেও তুলে ধরতে চায় সরকার। দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে ২০০৮ সালে। আগামী নির্বাচনে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের কাছে রাজনৈতিকভাবে সরকার বিশেষ সুবিধা পাবে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে। এ প্রকল্পের বিষয়ে সরকারের স্পর্শকাতরতার উদাহরণ দিতে গিয়ে সেতু বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, মাওয়া ফেরিঘাট সরানোর জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কয়েকবার তাগিদ দিয়েছে। এরপর গত ২০ নভেম্বরের মধ্যে ঘাট সরানোর সময় বেঁধে দেওয়া হয় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআইডব্লিউটিএ)। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে তারা ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় চায়। এটা জেনে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় তাৎক্ষণিক ঘাট সরানোর নির্দেশ দেয় এবং ২৭ নভেম্বরই ঘাট সরানো হয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এও জানান, প্রধানমন্ত্রী বিদেশে সফরে গেলে এসেই প্রথমে পদ্মা সেতুর কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে সর্বশেষ তথ্য সংগ্রহ করেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন। পদ্মা সেতু : স্বপ্ন ও বাস্তবতা : কাজ শুরুর আগেই সাড়ে ৮শ’ কোটি টাকা ব্যয়, আড়াই বছর কেটে গেছে ভাগবাটোয়ারা নিয়ে 14 September 2011 at 22:51 পদ্মা সেতু : স্বপ্ন ও বাস্তবতা : কাজ শুরুর আগেই সাড়ে ৮শ’ কোটি টাকা ব্যয়, আড়াই বছর কেটে গেছে ভাগবাটোয়ারা নিয়ে, দুর্নীতিতে অনেক ক্ষমতাধর ব্যক্তি জড়িত কাদের গনি চৌধুরী পদ্মা সেতুর স্বপ্ন কবে পূরণ হবে—এ ব্যাপারে কেউ নিশ্চিত নন। নির্বাচনের আগে ও সরকার গঠনের পর আওয়ামী লীগ নেতারা দেশের মানুষকে যেসব স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম ছিল পদ্মা সেতু। গত পৌনে ৩ বছরে প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও যোগাযোগমন্ত্রী অসংখ্যবার পদ্মা সেতুর কাজ শুরু এবং এ সরকারের আমলেই সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দিয়ে জনগণের করতালিও আদায় করে নেন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন। জোরেশোরে পদ্মা সেতুর কাজ শুরুর কথা বলে নির্মাণ ব্যয়ও বাড়ানো হয়েছে আড়াইগুণ। এরই মধ্যে সরকারের মেয়াদ অর্ধেক পেরিয়ে গেলেও এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের কিছুই হয়নি। এখন আনুষ্ঠানিকভাবেই এ সরকারের আমলে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হবে না বলে জানানো হয়েছে। দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে ঋণদাতা সংস্থাগুলোর কঠোর অবস্থানের কারণেই এমনটা হয়েছে বলে অর্থমন্ত্রী স্বীকার করেছেন। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২৯০ কোটি ডলার ব্যয়ে নির্মিতব্য দেশের দীর্ঘতম পদ্মা সেতুর জন্য বাংলাদেশের ২৫ কোটি ৭০ লাখ ডলার ছাড়া বাদবাকি অর্থ জোগান দেয়ার কথা ছিল বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ (এডিবি) বিভিন্ন ঋণদাতা সংস্থা। ঢাকঢোল পিটিয়ে শুরু করা এই সেতু প্রকল্পের কাজে এখন পর্যন্ত সরকারের ব্যয় হয়েছে ৮৫০ কোটি টাকারও বেশি। তবে এর নির্মাণ কাজ শুরুর আগেই বিপত্তি দেখা দিয়েছে। সেতু নির্মাণে তদারকি ও পরামর্শক কাজের জন্য দরদাতা একটি কানাডিয়ান পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণের অভিযোগ তুলেছে প্রধান ঋণদাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক। এ নিয়ে তাদের পক্ষ থেকে তদন্ত শুরুর আহ্বানও জানানো হয়েছে। এ জটিলতার কারণে ঋণের অর্থ ছাড় দিতে অস্বীকার করায় সেতু প্রকল্পের কাজ থমকে দাঁড়ানোর কথা বলা হয়েছে। এমন অবস্থায় দুর্নীতিগ্রস্ত কোনো প্রতিষ্ঠানকে পদ্মা সেতু প্রকল্পে নিয়োগ দেয়া হবে না বলে সরকারের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা করা হয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দেয়া ও নিজেদের গা বাঁচানোর জন্যই যে এমনটা করতে হয়েছে—সেটা সবাই বুঝে গেছে। সংবাদ সম্মেলনে প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের চেয়ারম্যানের উপস্থিত না থাকার ঘটনা সেটাই প্রমাণ করে। ফলে এ প্রকল্প নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ খণ্ডন করে স্বচ্ছতা প্রমাণের সর্বশেষ প্রচেষ্টাও ভেস্তে যেতে বসেছে। তাছাড়া পদ্মা সেতুর টেন্ডার ডকুমেন্টে এডিবির দুর্নীতিবিরোধী নীতিমালা ও ঠিকাদার নিয়োগে প্রযোজ্য শর্ত যুক্ত করা নিয়েও ঋণদাতা সংস্থাগুলো এবং সরকারের মধ্যে মতবিরোধ জটিল আকার নিয়েছে বলে জানা গেছে। এর মীমাংসা না হওয়ায় পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ শুরু নিয়ে অনিশ্চয়তা দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এসব নিয়ে যোগাযোগমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টার দৌড়-ঝাঁপের ফলাফল এখন পর্যন্ত শূন্য। দেশের সড়ক যোগাযোগের নজিরবিহীন বিপর্যয় যোগাযোগমন্ত্রীকে যখন ঘরে-বাইরে কোণঠাসা করে ফেলেছে, ঠিক তখনই পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ পূর্বঘোষণা মোতাবেক শেষ করতে না পারার স্বীকারোক্তি তার অযোগ্যতাকে আরও বড় করে তুলেছে। একইসঙ্গে এটি সরব সরকারের ব্যর্থতার মুকুটে আরেকটি পালক যুক্ত করার শামিল। ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই দুর্নীতি, অনিয়ম, অযোগ্যতার সব প্রশ্নেই ক্ষমতাসীনরা আগের জোট সরকারকে দায়ী করেছে, গালাগাল করে মুখে ফেনা তুলেছে; এখন দেখা যাচ্ছে তারা নিজেরাই সেসব অভিযোগে অভিযুক্ত। বার বার হোঁচট খাচ্ছে : বার বার হোঁচট খাচ্ছে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ। ভাগবাটোয়ারা নিয়ে কিনারা করতে না পারায় একের পর এক জটিলতা তৈরি হচ্ছে। হঠাত্ করে প্রকল্প ব্যয় আড়াইগুণ বৃদ্ধির পর থেকেই এ প্রকল্পের স্বচ্ছতা নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। বিশ্বব্যাংক দুর্নীতি আঁচ করতে পেরে প্রথম থেকেই এ প্রকল্পে অধিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা দাবি করে আসছিল। কাজ শুরুর আগেই জমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিপূরণ প্রদান, পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখিও হয়। এক পর্যায়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) পদ্মা সেতু নির্মাণকে ঘিরে দুর্নীতির আশঙ্কা অনুধাবন করে ২০০৯ সালের জুলাই মাসে ‘সততা চুক্তির রূপরেখা’ শিরোনামে একটি প্রস্তাব যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। এতে মন্ত্রণালয় এবং দরপত্রে অংশগ্রহণকারী পক্ষগুলোকে সম্পৃক্ত করে এ ধরনের একটি চুক্তি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সহযোগিতার প্রস্তাব করা হলেও মন্ত্রণালয়ের কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে টিআইবি। এদিকে এক ভোজসভায় যোগাযোগমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে ঢাকা থেকে ওয়াশিংটনে পাঠানো যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টির একটি গোপন বার্তা গত ৩০ আগস্ট প্রকাশ করে দেয় জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের হৈচৈ ফেলে দেয়া ওয়েবসাইট উইকিলিকস। আবুল হোসেনের ‘রেপুটেশন লেস দেন অনেস্ট’ উল্লেখ করে ওই বার্তায় বলা হয়, ‘দুর্নীতির অভিযোগ এখনও যোগাযোগমন্ত্রীকে ঘিরে আছে। তিনি যে পদ্ধতিতে কাজ করেন, তার বেশকিছু সমস্যার কথা বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা আমাদের জানিয়েছেন। তাছাড়া চীনের সঙ্গে মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের বিষয়টিও সবার জানা।’ ওই তারবার্তার ভিত্তিতে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলে আবুল হোসেন উইকিলিকসে প্রকাশিত নথির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। নিজেকে ‘পরীক্ষিত সেলাক’ দাবি করে ৪ সেপ্টেম্বর যোগাযোগমন্ত্রী দাবি করেন, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন সংক্রান্ত সব তথ্য টিআইবিতে পাঠানো হয়। কিন্তু সম্প্রতি গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে টিআইবি বলেছে, ‘যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের টেন্ডার সংক্রান্ত কয়েকটি দলিল টিআইবির কাছে ঠিকই পাঠানো হয়েছে। তবে তার ভিত্তিতে পদ্মা সেতু নির্মাণের টেন্ডার প্রক্রিয়া কিংবা যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমের স্বচ্ছতার মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। এরূপ মূল্যায়ন বা সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার বিষয়ে কোনোপ্রকার মন্তব্য করার জন্য যে ধরনের অনুসন্ধান ও সম্পৃক্ততার প্রয়োজন, সে সুযোগ টিআইবির হাতে নেই।’ সেতু বিভাগের একটি সূত্র জানায়, পদ্মা সেতুর কাজে দরপত্রে অংশ নেয়া বিভিন্ন সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে বিশ্বব্যাংকের কাছে। বিশেষ করে তদারকির কাজে প্রাথমিক তালিকায় থাকা একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় পদ্মা সেতুর অর্থায়নে জটিলতা দেখা দিয়েছে। এ সমস্যা সমাধানে বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মধ্যে আলোচনা চলছে। রোববার এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) আবাসিক প্রতিনিধি থেবাকুমার কান্দিয়াহ এক চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের কাছে দুর্নীতির অভিযোগের কথা স্বীকার করেন। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এনইসি সম্মেলন কক্ষে সরকার ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মধ্যে আড়াই কোটি মার্কিন ডলারের এ ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। তিনি বলেন, দুর্নীতি রোধ ও ক্রয়ের (প্রকিউরমেন্ট) ক্ষেত্রে আমাদের নিজস্ব একটি গাইডলাইন আছে, পদ্মা সেতু প্রকল্পে এর প্রয়োগ দেখতে চায় এডিবি। সূত্র জানায়, পদ্মা সেতু প্রকল্পে এসএনসি-লাভালিন গ্রুপ নামের একটি কানাডীয় প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি বিশ্বব্যাংকের অনুরোধে তদন্ত করছে কানাডা। পদ্মা সেতু প্রকল্পের তদারকি প্রতিষ্ঠান নির্বাচনে তৈরি হওয়া সংক্ষিপ্ত তালিকায় এসএনসি-লাভালিন রয়েছে। এ কারণে পদ্মা সেতু প্রকল্প এগিয়ে নিতে দেরি হচ্ছে। শনিবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও একই কথা জানান। এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এডিবির আবাসিক প্রতিনিধি বলেন, এ নিয়ে ম্যানিলা-ওয়াশিংটন করপোরেট লেভেলে আলোচনা হচ্ছে। রোববার অর্থ মন্ত্রণালয়ে বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ইসাবেল এম গেরেরোর সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর বৈঠক হয়। তবে বৈঠকের বিষয়ে কেউই সাংবাদিকদের কিছু বলেননি। অবশ্য অর্থমন্ত্রী আশা করছেন, আগামী জানুয়ারির মধ্যেই পদ্মা সেতু নির্মাণের চূড়ান্ত দরপত্র আহ্বান করা যাবে। সোমবার সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে অর্থমন্ত্রী বলেন, পদ্মা সেতুর কাজে দরপত্রে অংশ নেয়া বিভিন্ন সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে বিশ্বব্যাংকের কাছে। তিনি অভিযুক্ত এসব সংস্থার নাম প্রকাশের অনুরোধ জানিয়েছেন। অর্থমন্ত্রী জানান, অভিযুক্ত কোম্পানির শাস্তি হবে তার দেশের আইনে। আমরা এমন অভিযুক্ত কোম্পানিগুলোকে বাদ দিয়ে কাজ করতে চাই। অভিযোগ প্রমাণ হলো কিনা, তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। এসময় অর্থমন্ত্রীর কাছে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন, যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ বিশ্বব্যাংকের কাছে আছে কিনা। এর জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, এভিডেন্স দেখার পর বিশ্বব্যাংক জানাবে তার (যোগাযোগমন্ত্রীর) বিরুদ্ধে কোনো রিজার্ভেশন আছে কিনা। এর আগে আমি এ বিষয়ে কিছুই বলতে পারব না। অর্থমন্ত্রী বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজের বিষয়টি বিশ্বব্যাংকের কারণে আটকে আছে। সেতু নির্মাণসংশ্লিষ্ট কাজের জন্য শর্টলিস্ট করা সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। কানাডাভিত্তিক একটি সংস্থার বিষয়ে তদন্ত চলছে। আর কয়েকটি সংস্থার বিরুদ্ধে ‘এভিডেন্স’ এসেছে বিশ্বব্যাংকের হাতে। এগুলো নিষ্পত্তি না হওয়ায় সেতু তৈরির কাজ বিলম্ব হচ্ছে। আবুল মাল আবদুল মুহিত জানান, পদ্মা সেতু নির্মাণে পরামর্শক নিয়োগ, সেতুর জন্য টেন্ডার আহ্বান এবং নদীশাসন সংক্রান্ত কাজের অগ্রগতি হচ্ছে না। বিশ্বব্যাংক এ তিনটি বিষয়ে ‘ওকে’ করলে টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরু হবে। আগে আমরা আশা করেছিলাম অক্টোবরে এ প্রক্রিয়া শুরু করতে পারব। এখন মনে হচ্ছে আরও কিছু সময় লাগবে। জানুয়ারির দিকে শুরু করতে পারব। তিনি জানান, বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভায় যোগ দিতে চলতি মাসেই তিনি ওয়াশিংটন যাচ্ছেন। সেখানে বিভিন্ন কোম্পানি সম্পর্কে যেসব অভিযোগ এসেছে, তা নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা হবে। আবুল মাল আবদুল মুহিত সাংবাদিকদের জানান, রোববার বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট একদিনের জন্য ঢাকা সফরে এসেছিলেন। এসময় তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও দেখা করেছেন। অর্থমন্ত্রী জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্টকে বলেছেন, অভিযুক্ত কোম্পানিকে বাদ দিয়েই আমরা কাজ করতে চাই। এজন্য অভিযোগগুলো জানাতে বলেছেন। বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তা অর্থমন্ত্রীকে জানিয়েছেন, অভিযোগ এসেছে। এগুলো তারা দেখছেন। ওয়াশিংটন সফরের সময় এসব বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। কাজ শুরুর যত ঘোষণা : বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার ১৫ দিনের মাথায় পদ্মা সেতু প্রকল্প হাতে নেয়। এরপর থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ১৭ বার কাজ শুরুর সময় ঘোষণা করা হয়। অথচ এখনও কাজ শুরু করা যায়নি। সর্বশেষ ঘোষণাটি আসে ৮ জুলাই। পদ্মাতীরে মাওয়া রেস্টহাউসে সাংবাদিকদের যোগাযোগমন্ত্রী জানান, এ মাসেই পদ্মা সেতুর দরপত্র আহ্বান করা হবে। অন্যান্য প্রক্রিয়া শেষ করে জানুয়ারিতে মূল সেতুর কাজ শুরু হবে। এর আগে ১৩ মার্চ গোপালগঞ্জ সার্কিট হাউস সম্মেলন কক্ষে এক মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন বলেন, আগামী মাসে (এপ্রিল) পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হবে। এছাড়া পদ্মা সেতুর সঙ্গে নির্মিত হবে রেলপথ। সেতু নির্মাণের ১৮ হাজার কোটি টাকা এখন সরকারের হাতে। এর আগে ২০১০ সালের ২২ মে জানান, সেপ্টেম্বরে শুরু হবে পদ্মা সেতুর কাজ। ২৭ সেপ্টেম্বর জানিয়েছিলেন, এ বছরই পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করব। একই বছরের ২০ অক্টোবর তিনি বলেছিলেন, মার্চে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হবে। ২০১১ সালের ১ জুন জাতীয় সংসদে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন বলেছেন, আগামী ২-৩ মাসের মধ্যেই পদ্মা সেতুর চূড়ান্ত কাজ শুরু হবে। তিনি বলেন, এরই মধ্যে মূল সেতু, নদীশাসন, সংযোগ সড়ক এবং ব্রিজ অ্যান্ড ফ্যাসিলিটিজের বিস্তারিত ডিজাইন চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর আগে ৬ এপ্রিল সংসদ ভবনে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভা শেষে তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, চলতি মাসে টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন শেষে জুলাইয়ে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হবে। ১০ এপ্রিল তিনি জানিয়েছিলেন, চলতি মাসেই পদ্মা সেতুর চূড়ান্ত দরপত্র আহ্বান করা হবে। ২০০৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর তিনি জানিয়েছিলেন, ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে পদ্মা সেতু নির্মাণের দরপত্র ডাকা হবে। ওই বছরের ৩০ অক্টোবর তিনি বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণের কার্যাদেশ আগামী বছর দেয়া হবে। ২০১৩ সালের মধ্যে এর নির্মাণ কাজ শেষ হবে। এভাবে ১৭ বার পদ্মা সেতুর কাজ শুরুর সময় ঘোষণা দেন যোগাযোগমন্ত্রী। সরকার ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যে বিরোধের কারণ : পদ্মা সেতু নিয়ে সরকার ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয় মূলত বার বার প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি এবং প্রি-কোয়ালিফিকেশন টেন্ডারে প্রাকযোগ্য বিবেচনা নিয়ে। বিশ্বব্যাংক বলছে, প্রি- কোয়ালিফিকেশন টেন্ডারে প্রাকযোগ্য বিবেচনায় অনিয়ম করেছেন যোগাযোগমন্ত্রী। অপরদিকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় বলছে, পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার ব্যাপারে সম্মত না হওয়ায় বিশ্বব্যাংক কাজের অনুমতি দিতে গড়িমসি করছে। এর ফলে বিশ্বের অন্যতম ব্যয়বহুল এ সেতুটির কাজ কবে শুরু হবে—তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। স্বয়ং যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন এ ব্যাপারে সহযোগিতা চেয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে চিঠি দিয়েছেন। ২১ জুন লেখা এ চিঠিতে বলা হয়, ‘পদ্মা সেতু আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রকল্প। এ প্রকল্প প্রক্রিয়াকরণে সেতু বিভাগ শতভাগ স্বচ্ছতা, দক্ষতা, দ্রুততা, সরকারি নিয়মকানুন ও বিশ্বব্যাংকের গাইডলাইন অনুসরণ করেছে। এতে কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বিশ্বব্যাংকের অনুমতি আদায়ের জন্য যোগাযোগমন্ত্রী অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে সহযোগিতা চেয়েছেন। অর্থমন্ত্রীকে লেখা চিঠির শেষাংশে তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকের প্রক্রিয়াগত বিলম্বের কারণে পদ্মা সেতুর নির্মাণ নিয়ে আশঙ্কার ধূম্রজাল সৃষ্টি করা হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে আমরা মনে করি, পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের সম্মতির বিষয়টি নিয়ে তাদের সঙ্গে আপনার কথা বলা প্রয়োজন। এতে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন কার্যক্রমে অহেতুক বিলম্ব দূর হবে এবং নির্মাণ কাজ শুরুর কার্যক্রম ত্বরান্বিত হবে। এদিকে বিশ্বব্যাংক গত ১৪ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছে, পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থ খরচে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতা দেখতে চায় বিশ্বব্যাংক। তদারকির জন্য একটি স্বতন্ত্র কমিটি গঠনের সুপারিশ করেছে এই উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানটি। বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসে অনুষ্ঠিত এ সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বিশ্বব্যাংকের স্থানীয় কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে এই সুপারিশ করেছেন এবং প্রধানমন্ত্রীও তাদের সুপারিশের পক্ষে মত দিয়েছেন। সরকার ও উন্নয়ন সহযোগীদের বাইরে তৃতীয় পক্ষের বিশেষজ্ঞরা এ দলের সদস্য হিসেবে থাকবেন। বিশ্বব্যাংকের স্থানীয় অফিসে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) অতিরিক্ত সচিব আরাস্তু খান, বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর অ্যালেন গোল্ডস্টেইনসহ বিশ্বব্যাংকের অন্যান্য কর্মকর্তা। তদারকির জন্য স্বতন্ত্র দল গঠন সম্পর্কে অ্যালেন গোল্ডস্টেইন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে; কিন্তু এই অর্থ কীভাবে খরচ হবে—সেটা জানার অধিকার বাংলাদেশের মানুষের রয়েছে। এছাড়া উন্নয়ন সহযোগীরাও চায় অর্থ খরচের প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহির মধ্যে থাকুক। এ সম্পর্কে আরাস্তু খান বলেন, ‘গ্রহণযোগ্যতার জন্য স্বতন্ত্র তদারকি দল গঠনের চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। এ দল গঠিত হলে প্রকল্পের অর্থ ব্যয়ে স্বচ্ছ ও জবাবদিহি থাকবে। এর মানে এই নয় যে, বিশ্বব্যাংক সরকারকে কোনো শর্ত দিচ্ছে। দুর্নীতির ধারণাসূচক অনুযায়ী বলা হয়, বাংলাদেশ অন্যতম দুর্নীতিপরায়ণ দেশ।’ সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ রাখতে তথ্য অধিকার আইন পুরোপুরি অনুসরণ করা হবে। প্রকল্প এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের সঙ্গে পুনর্বাসনসংক্রান্ত জবাবদিহিমূলক বৈঠকও করা হবে। এছাড়া একজন নিরপেক্ষ পরামর্শক নিয়োগ করা হবে, যিনি সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকে প্রতিবেদন দেবেন। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চার দফা পদ্মা সেতুর ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়। জানুয়ারির মাঝামাঝি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণের সর্বশেষ সংশোধিত প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়। সংশোধনের পর এই সেতু নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ২০ হাজার ৫০৭ কোটি ২০ লাখ ১৬ হাজার টাকা। এর আগে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ২০ আগস্ট অনুষ্ঠিত একনেকের বৈঠকে ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ ১০ হাজার টাকা ব্যয় ধরে পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। কাজ শুরুর আগেই প্রকল্প ব্যয় দ্বিগুণ বৃদ্ধি করায় নানা সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে সরকারকে। তাই বিশ্বব্যাংক এ ব্যাপারে বার বার জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার কথা বলে আসছে। বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল সেতু : বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল সেতু বাংলাদেশের পদ্মা সেতু। বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ চীনের হাঙজু বে ব্রিজের দ্বিগুণ ব্যয় ধরা হয়েছে এ সেতুর জন্য। অথচ বাংলাদেশের এ সেতুর চেয়ে হাঙজু বে ব্রিজ প্রায় ছয়গুণ বড়। মাত্র দু’বছর আগে হাঙজু সেতুর কাজ শেষ হয়েছে। হাঙজু বে ব্রিজ ৩৬ কিলোমিটার দীর্ঘ। আর পদ্মা সেতু মাত্র ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। কেউ হিসাব মেলাতে পারছেন না কেন এত অস্বাভাবিক ব্যয় ধরা হলো পদ্মা সেতুর? এ নিয়ে হৈচৈ পড়ে যায় দেশজুড়ে। বাংলাদেশের বৃহত্তম সেতু হিসেবে পদ্মা সেতু নির্মাণের সর্বশেষ ব্যয় ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১০ সালের ২৯ ডিসেম্বর তৃতীয় বুড়িগঙ্গা সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনকালে তিনি জানান, পদ্মা সেতু নির্মাণে ব্যয় হবে ২৬০ কোটি মার্কিন ডলার বা ১৮ হাজার ২শ’ কোটি টাকা। এর মাত্র ১০ দিন আগে ২১ ডিসেম্বর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বিষয়ক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের জানান, এ সেতু নির্মাণে ব্যয় হবে ২৪০ কোটি মার্কিন ডলার বা ১৬ হাজার ৮শ’ কোটি টাকা। অক্টোবরে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণে ব্যয় হবে ১৯০ কোটি মার্কিন ডলার। ২০০৭ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা বা ১৪৭ কোটি ২৭ লাখ ডলারে প্রথম প্রকল্পটি অনুমোদন করেছিল। বলা হয়েছিল, ২০১৫ সালের মধ্যে সেতু তৈরি হবে। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন্স এজেন্সির (জাইকা) সুপারিশ মেনে ২০০৪ সালে মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টে স্থিরকৃত পদ্মা সেতু নির্মাণে সম্ভাব্য ব্যয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ধরা হয়েছিল ১৪০ কোটি ডলার। অর্থাত্ নির্মাণ ব্যয় বেড়ে গেছে দ্বিগুণ। সর্বশেষ এ বছরের ১০ জানুয়ারি একনেকে পদ্মা সেতুর ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি ২০ লাখ ১৬ হাজার টাকা। মাওয়া থেকে জাজিরা পর্যন্ত চার লেনবিশিষ্ট পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ২৩ দশমিক ৬ মিটার। দ্বিতল এ সেতুর ওপরে সড়ক আর নিচ দিয়ে যাবে রেলপথ। অথচ আধুনিক স্থাপত্যবিদ্যার অসাধারণ নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃত চীনের হাঙজু ব্রিজ নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১৭০ কোটি মার্কিন ডলার। এ ব্রিজের দৈর্ঘ্য ৩৬ কিলোমিটার। যা পদ্মা সেতুর চেয়ে প্রায় ছয়গুণ বড়। তাছাড়া পদ্মা সেতু তৈরি হচ্ছে নদীর ওপর; আর হাংজু তৈরি করা হয়েছে সাগরের বুক চিরে। চীনের হাঙজু উপসাগরের ওপর ৩৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু সাড়ে তিন বছরে শেষ করে ২০০৯ সালে সেতুটি উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। অনিয়মে অনেক রাঘববোয়াল জড়িত : যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, পদ্মা সেতুর অনিয়মে শুধু যোগাযোগমন্ত্রী একাই জড়িত নন। এর সঙ্গে সরকারের বাইরের ক্ষমতাধর ব্যক্তিরাও জড়িত আছেন। যারা যোগাযোগমন্ত্রীর মন্ত্রিত্ব রক্ষায় সহায়তা করছেন। সূত্র জানায়, ব্যর্থতা ও দুর্নীতির অভিযোগে সরকারি দল, বিরোধী দল, সুশীল সমাজ যেভাবে যোগাযোগমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করে আসছে, এটি বাংলাদেশে নজিরবিহীন ঘটনা। অথচ এরপরও তিনি বহালতবিয়তে টিকে আছেন পেছনের শক্তির কারণে। আর ওই শক্তির ওপর ভর করেই তিনি একের পর এক অনিয়ম করেই চলেছেন।